নীরবে নিঃশব্দে বয়ে যায় সময়নদীর স্রোত। কী জানি কোন সংগোপন বিলাসে।
"কালের যাত্রার ধ্বনি শুনিতে কি পাও?
তারি রথ নিত্যই উধাও "...
রথের নির্মোঘ চলমানতার শব্দতরঙ্গ কোনদিন শোনা যায় না। কিন্তু তার নির্বিকার, নির্মম চাকায় পিষ্ট হয় বিহবল আনন্দ।
ঝিলিমিলি বর্তমান হারিয়ে যায় ব্যথিত অতীতের ছায়াপথ ধরে।
বিস্মৃতির নিতল অন্ধকারে তলিয়ে যায় সবুজপাতার লাবণ্যপ্রভা,
ফুলের বসন্তবৈভব,
সংগীতের মধুরিমা,
ভালোবাসার সুরম্যবিষাদ।
তবু মাঝে মাঝে বিস্মিত, বিমূঢ়, হতবাক কোনো নৈঃশব্দ্য -দুপুরে, বিষণ্ন বিকেলে, সায়ন্তের নিঝুমতায় , রাতের বিবাগি বাতাসে বেজে উঠে বাউলের একতারা। বাজতেই থাকে। তখন দূর সুদূর প্রবালদ্বীপের ঘুম ভাঙায় চির চেনা অথচ চির অচেনা এক অকূল সমুদ্দুর। আর গাংচিলের পাখায় পাখায় ভাসে দিগন্তব্যাপ্ত আর্তি, হে অতীত, কথা কও।
প্রকৃতির অমোঘ নিয়মেই আসে নতুন বছর অর্থাৎ নববর্ষের আবাহন।
"বিশ্বে প্রথম নববর্ষের খবর পাওয়া যায় মেসোপটেমিয়ায় খ্রিস্ট পূর্ব ২০০০ অব্দে। তখন ইংরেজি মাস কখনও মার্চ, সেপ্টেম্বর বা ডিসেম্বরেও হত এবং নববর্ষও সেভাবেই গণ্য হত। ইংরেজি নববর্ষের ইতিহাস আলোচনা করলে জানা যায়, ৪৬ খ্রিস্ট পূর্ব অব্দে জুলিয়াস সিজার যখন বাৎসরিক ক্যালেন্ডার পরিবর্তন করেন এবং বর্তমানে প্রচলিত জানুয়ারি মাসকেই প্রথম মাস হিসেবে ধার্য করেন_ তখন থেকেই বিপুল জাঁকজমক ও আনন্দ উল্লাসের সঙ্গে ইংরেজি নববর্ষ পালিত হয়ে আসছে । "১
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিচিত্রমাত্রিক বর্ণবিভঙ্গে, নামে নববর্ষ পালিত হয়ে থাকে। যেমন, ইরানিদের নববর্ষ 'নওরোজ। (যে প্রথা মুঘল সম্রাটগণ ভারতবর্ষে প্রচলন করেন ।)
বৈশাখ বাংলা সনের প্রথম মাস। এ মাসের প্রথম দিনটি পহেলা বৈশাখ। অর্থাৎ বাঙালিদের নববর্ষ হল, পহেলা বৈশাখ। আনন্দ, স্বতঃস্ফূর্ততা, অবিরল প্রাণ বন্যার হিল্লোলিত কলগুঞ্জনে পহেলা বৈশাখ নিয়ে আসে হিরণ্ময় ব্যঞ্জনা। এর প্রধান বৈশিষ্ট্য হল, কোন সম্প্রদায়ের সীমিত পরিসরে পহেলা বৈশাখ বৃত্তাবদ্ধ নয়।আমাদের কৃষি,সংস্কৃতি আর জীবনায়নে পহেলা বৈশাখ চিরায়ত গ্রাম বাংলার অমলিন উৎসব ।আবহমান লোকসংস্কৃতির চিত্তরঞ্জী আর দৃষ্টিনন্দন আয়োজন। পত্র -পুষ্পে, আবরণে, আভরণে, প্রসাধনে,ভাব গভীরতায়, মহিমায় এককথায় অসাম্প্রদায়িক উৎসবের দিগন্তব্যাপ্ত নির্মল এক আনন্দ মেলা।
"আমরা হয়ত অনেকেই জানি না মিলাদ মাহফিল , বয়াতির আসর, জারি, সারি, মর্সিয়া, পুঁথি পাঠের মজলিস জমিয়ে প্রজা সাধারণ ও কৃষককুলকে সম্পৃক্ত করে নিয়ে পয়লা বৈশাখের উৎসব প্রথম সূচনা করেছিলেন টাঙ্গাইলের ধন বাড়ির নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী। তিনি বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রথম প্রস্তাবক। তাঁরই নেতৃত্বে পরিচালিত আন্দোলনের ফসল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। তিনিই বাংলা ভাষায় মিলাদ শরীফের প্রথম প্রবর্তক। "২
বাংলা সনের উদ্ভাবক বিষয়ে মতভেদ আছে। এক্ষেত্রে যাঁদের নাম উল্লেখ আছে তাঁরা হলেন, বাংলায় প্রথম স্বাধীন নরপতি শশাঙ্ক (৫৯৩ থেকে ৬৩৫ খ্রিস্টাব্দ),আলাউদ্দিন হোসেন শাহ (১৪৯৩ থেকে ১৫১৯ খ্রিস্টাব্দ), সম্রাট আকবর (১৫৫৬ থেকে ১৬০৫ খ্রিস্টাব্দ) । কোন কোন গবেষক রাজা বিক্রমাদিত্যের নামও উল্লেখ করেছেন। এসব অস্পষ্টতা আর ধুম্রজাল এড়িয়ে আমরা সর্বজনগ্রাহ্য তথ্য বিষয়ে একটু আলোকপাতের চেষ্টা করব।
সম্রাট আকবরের আগে এদেশে খাজনা প্রদানে নানা জটিলতা ছিল। তখন বছর শুরু হত চৈত্র মাসে অর্থাৎ রবি ফসল তোলার মাসে। এতে দিন, ক্ষণ তারিখের পরিবর্তন জনিত কারণে খাজনা প্রদানে নানা জটিলতা দেখা দেয়।
এদেশের প্রজাসাধারণ যাতে পূর্বের জটিলতা থেকে মুক্ত হয়ে নির্দিষ্ট মাসে খাজনা দিতে পারে এ বিষয়ে সম্রাট আকবর এক দূরদর্শী উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তিনি একটি বিজ্ঞান নির্ভর ও ত্রুটিমুক্ত সন উদ্ভাবন করার জন্য তাঁর বিশিষ্ট পরামর্শক ও সভা জ্যোতিষশাস্ত্রবিদ পণ্ডিত আমির হতেহ উল্লাহ সিরাজীকে নির্দেশ দান করেন।পণ্ডিত আমির ফতেহ উল্লাহ সিরাজীর গবেষণার ফলেই বাংলা সনের উৎপত্তি। তখন থেকেই বাংলা বছর শুরু হওয়ার মাস এবং খাজনা প্রদানের নির্দিষ্ট মাস হিসাবে বৈশাখকেই নির্দিষ্ট করা হয়। এতে প্রজা সাধারণও বিশেষ সুবিধা প্রাপ্ত হলেন। তখন থেকে' সন' শব্দটিও চালু হল। শব্দটি আরবি ভাষা থেকে আগত। এর অর্থ_ বর্ষ, বর্ষপঞ্জি , বছরের দিন ক্ষণের বিবরণ। সিরাজী উদ্ভাবিত এবং সুনির্দিষ্ট ক্ষণ নির্ভর এই সনই বাংলা সন বলে' আকবরনামা'য় উল্লেখ আছে।
আজ পহেলা বৈশাখের বিভাসিত উদ্ভাসে আমাদের কাঙ্ক্ষা হোক সত্য,সুন্দর আর কল্যাণ। মানবিকতার মহৎ মহিমায় উজ্জীবিত হোক আমাদের মন,মনন, চৈতন্য। আমরা আরও দীপ্র হব। প্রদীপ্ত হব। অবিরল আলোর কূলপ্লাবী ধারাস্রোতে ধুয়ে মুছে নিঃশেষ হয়ে যাক সব গ্লানি, কালিমা ম্লানিমা, ঝরা পাতা।
আমরা নতুন বছরকে (১৪৩২)আমন্ত্রণ জানাই ছন্দের হিল্লোলিত মূর্ছনায়,
"হে নূতন, এসো তুমি সম্পূর্ণ গগন পূর্ণ করি /
পুঞ্জ পুঞ্জ রূপে /_
ব্যাপ্ত করি লুপ্ত করি স্তরে স্তরে স্তবকে স্তবকে/
ঘনঘোরস্তূপে। "
তথ্যসূত্র
১. ড. আশরাফ সিদ্দিকী, তোরা সব জয়ধ্বনি কর, মিয়াজী পাবলিকেশন্স, ১৪১০, পৃ: ১৫৪।
২. আবুল কালাম মঞ্জুর মোরশেদ সম্পাদিত নববর্ষ ও বাংলার লোক-সংস্কৃতি, অ. আ প্রকাশন, পরিবেশক সূচীপত্র, ১৪০৯,পৃ: ১৭।
নিউজটি আপডেট করেছেন : Suprobhat Michigan